ভারতের আবহাওয়া ও জলবায়ু এক বৈচিত্র্যময় এবং বৈশ্বিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। ভারতের ভূগোল এবং আঞ্চলিক পরিবর্তনের কারণে এখানে বিভিন্ন ধরনের জলবায়ু পরিলক্ষিত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে মূলত পাঁচটি প্রধান জলবায়ু অঞ্চলের শ্রেণীবিভাগ করা হয়: তাপীয়, ঋতুভিত্তিক, সমুদ্রতীরবর্তী, প্রাচীন মরু, এবং উচ্চ পর্বতীয়। তবে, ভারতের জলবায়ু মূলত মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাবে প্রভাবিত।
১. মৌসুমী (Monsoon) জলবায়ু
ভারতের জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো মৌসুমী প্রভাব। মৌসুমী জলবায়ু মূলত দুইটি মৌসুমে বিভক্ত:
গরম মৌসুম (মার্চ থেকে জুন)
গরম মৌসুমে ভারতজুড়ে তাপমাত্রা অনেকটা বেড়ে যায়। উত্তর ভারত এবং পশ্চিমের মরুভূমিতে তাপমাত্রা ৪০°C এর কাছাকাছি পৌঁছে যায়, তবে দক্ষিণ ভারতে তাপমাত্রা কিছুটা কম থাকে। এই সময়ে আর্দ্রতা বাড়ে এবং শুষ্কতা দেখা দেয়।
বর্ষা মৌসুম (জুন থেকে সেপ্টেম্বর)
ভারতের আবহাওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো বর্ষা মৌসুম। জুনের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলে ভারী বৃষ্টি হয়, যা দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু দ্বারা পরিচালিত হয়। বর্ষার ফলে দেশের কৃষির উন্নতি ঘটে এবং পানির সঙ্কট মেটানো যায়। ভারতের পশ্চিম উপকূলে, পশ্চিমঘাট, উত্তর-পূর্ব ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গের অংশে বর্ষা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
শীতকাল (অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি)
শীতকাল সাধারণত তাপমাত্রা কমে যায়, বিশেষত উত্তর ভারতে। শীতকালীন মৌসুমে উত্তর ভারতে তাপমাত্রা ৮°C-১০°C এর মধ্যে থাকে, তবে দক্ষিণ ভারতে এটি অনেক উষ্ণ থাকে। শীতকাল হলো ভারতের কৃষির জন্য একেবারে উপযোগী সময়, কারণ এর ফলে বীজবপন, ফসলের বৃদ্ধি এবং খাদ্য উৎপাদনে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
২. ভারতের প্রধান জলবায়ু অঞ্চল
ভারতীয় জলবায়ুকে সাধারণত ছয়টি প্রধান অঞ্চলে ভাগ করা হয়:
(১) উষ্ণ বা গরম জলবায়ু (Tropical Climate)
ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চল উষ্ণ জলবায়ুর অধিকারী। দক্ষিণ ভারত, পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব ভারত এই শ্রেণীতে পড়ে। এখানে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা ৩০°C-৪৫°C পর্যন্ত পৌঁছে। বর্ষা মৌসুমে এই অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টি হয়।
(২) শুষ্ক বা মরু জলবায়ু (Desert Climate)
রাজস্থান, গুজরাটের কিছু অংশ এবং থার মরুভূমির মতো এলাকায় শুষ্ক জলবায়ু দেখা যায়। এখানে বৃষ্টিপাত খুব কম এবং তাপমাত্রা দিনে অত্যন্ত বেড়ে যায়, কিন্তু রাতে তাপমাত্রা হালকা থেকে শীতল হয়।
(৩) মৃদু বা উপ-উষ্ণ জলবায়ু (Sub-Tropical Climate)
এই ধরনের জলবায়ু উত্তর ভারতের কিছু অংশে দেখা যায়, যেমন হিমাচল প্রদেশ, পঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশ। শীতকাল এখানে ঠান্ডা এবং গ্রীষ্মকাল উষ্ণ থাকে।
(৪) উপকূলীয় জলবায়ু (Coastal Climate)
ভারতের উপকূলীয় অঞ্চল যেমন কেরালার উপকূল, পশ্চিমবঙ্গ এবং মহারাষ্ট্রের উপকূলীয় অঞ্চল উষ্ণ, আর্দ্র জলবায়ুর অধিকারী। এখানে বর্ষা মৌসুমে প্রচুর বৃষ্টি হয় এবং বছরের অধিকাংশ সময় আর্দ্রতা থাকে।
(৫) উচ্চ পর্বতীয় জলবায়ু (Mountain Climate)
হিমালয় পর্বত এবং অন্যান্য পর্বতীয় অঞ্চল যেমন কাশ্মীর, নেপাল, সিকিমে উচ্চ পর্বতীয় জলবায়ু দেখা যায়। এখানে শীতকালে তুষারপাত হয় এবং তাপমাত্রা শূন্যের নিচে চলে যায়। গ্রীষ্মকালে ঠান্ডা থাকে।
(৬) বনাঞ্চল জলবায়ু (Tropical Rainforest Climate)
পশ্চিমঘাট, অন্ধ্রপ্রদেশের কিছু অংশ এবং অরুণাচল প্রদেশের কিছু অঞ্চলে এ ধরনের জলবায়ু দেখা যায়। এখানে বছরের প্রায় সব সময় বৃষ্টি হয় এবং গ্রীষ্মকাল উষ্ণ ও আর্দ্র থাকে।
৩. ভারতের জলবায়ু প্রভাবিত অঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য
- দক্ষিণ ভারত: দক্ষিণ ভারতের জলবায়ু প্রধানত গরম এবং আর্দ্র, তবে পশ্চিম ঘাট অঞ্চলে বর্ষার পরিমাণ বেশি।
- উত্তর-পশ্চিম ভারত (রাজস্থান): এখানে মরুভূমির প্রভাব, শুষ্ক এবং তাপমাত্রা খুব বেশি থাকে।
- উত্তর-পূর্ব ভারত: এই অঞ্চলের বর্ষা অত্যন্ত প্রচুর, যা দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমী বায়ু দ্বারা প্রভাবিত।
- হিমালয় অঞ্চল: হিমালয়ে শীতকাল খুব ঠান্ডা এবং বর্ষার সময় ভারী বৃষ্টিপাত হয়, বিশেষত উত্তরাখণ্ড, সিকিম এবং কাশ্মীর অঞ্চলে।
৪. জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাব
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ভারতেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের প্যাটার্ন, সাইক্লোন এবং ঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি, শুষ্কতা এবং বন্যার প্রকোপ বৃদ্ধি ইত্যাদি সমস্যা বাড়ছে। এসব পরিবেশগত পরিবর্তন ভারতের কৃষি, পানি সরবরাহ, এবং জনগণের জীবিকা ও স্বাস্থ্যেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
উপসংহার
ভারতের আবহাওয়া ও জলবায়ু অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় এবং স্থানীয় ভূগোলের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের জলবায়ু দেখা যায়। এই বৈচিত্র্য ভারতীয় কৃষি, অর্থনীতি, এবং জীবনযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, জলবায়ু পরিবর্তন ও তার সাথে সম্পর্কিত সমস্যা মোকাবেলা করতে যথাযথ পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের ভূমিরূপ (Landforms of India)
ভারতের ভূমিরূপ (Landforms of India) অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় এবং তা দেশের ভূগোল, জলবায়ু, এবং পরিবেশগত পরিস্থিতির সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। ভারতের ভূমিরূপ নানা ধরনের প্রাকৃতিক কাঠামো এবং প্রকৃতি দ্বারা গঠিত, যা উপমহাদেশের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিভিন্ন রকমের। এই ভূমিরূপ গুলি প্রধানত সৃষ্ট হয়েছে ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া (Geological processes), ভূকম্পন (Earthquakes), শিলা ক্ষয় (Erosion), বরফাবৃত অঞ্চলে গলন (Glaciation) এবং অবস্থানগত পরিবর্তন (Tectonic activities) এর মাধ্যমে।
ভারতের ভূমিরূপ সাধারণত ছয়টি প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করা যায়:
১. উত্তর-তৎকালীন হিমালয় অঞ্চল (Himalayan Mountain Ranges)
ভারতের উত্তর সীমান্তে হিমালয় পর্বতমালা পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশ্রেণী হিসেবে পরিচিত। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ২,৪০০ কিলোমিটার এবং এটি ভারতের পাঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ, এবং নেপালের সঙ্গে সীমান্ত ঘেঁষে রয়েছে। হিমালয় পর্বতমালা কিছু প্রধান অংশে ভাগ করা যায়:
- পশ্চিম হিমালয় (যেমন কাশ্মীর)
- মধ্য হিমালয় (যেমন হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড)
- পূর্ব হিমালয় (যেমন সিকিম, অরুণাচল প্রদেশ)
হিমালয়ে বেশ কয়েকটি উচ্চ পর্বত, চূড়া এবং গিরিপথ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হল এভারেস্ট, কাশ্মীরের পানমুনা এবং নন্দাদেবী। হিমালয়ে অনেকগুলি নদী (যেমন গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র) উৎপন্ন হয়, যা ভারত এবং প্রতিবেশী দেশগুলির জন্য গুরুত্বপূর্ণ জলস্রোত হিসেবে কাজ করে।
২. দক্ষিণ ভারতীয় প্লেটু (Deccan Plateau)
দক্ষিণ ভারতীয় প্লেটু ভারতের প্রধান ভূমিরূপের মধ্যে অন্যতম। এটি প্রায় ১,০০০ মিটার উচ্চতায় বিস্তৃত একটি বড় ভূমিরূপ, যা দেশের দক্ষিণ অংশে অবস্থিত। এই প্লেটুর মধ্যে কয়েকটি প্রধান অংশের মধ্যে রয়েছে:
- মাহাদেশ্বর পর্বতমালা
- নিলগিরি পাহাড়
- অলগাড় পর্বতমালা
এই প্লেটুটি প্রধানত প্রাচীন বেসাল্ট শিলা (basalt rock) দ্বারা গঠিত, যা ভলকানিক কার্যকলাপের ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয়েছে। এই অঞ্চলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নদী প্রবাহিত হয়, যেমন কৃষ্ণা, গঙ্গা, কাবেরী এবং তুম্বাদী।
৩. সুবিধা অঞ্চল (Indo-Gangetic Plain)
ভারতের উত্তরভাগে হিমালয়ের পাদদেশে একটি বিস্তৃত এবং সমতল এলাকা রয়েছে, যেটি ইন্দো-গঙ্গা সমভূমি বা ইন্দো-গাঙ্গেটিক প্লেইন নামে পরিচিত। এটি প্রধানত উর্বর জমি (Fertile Land) হিসেবে পরিচিত এবং ভারতের কৃষির কেন্দ্রস্থল। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, সিন্ধু, কাবেরী এবং নর্মদা নদীর মতো বড় নদীগুলি এই সমভূমিতে প্রবাহিত হয়। এই অঞ্চলে বন্যা এবং ধ্বংসাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রায়ই ঘটে, তবে বৃষ্টির পাশাপাশি মাটির উর্বরতা এখানকার কৃষি জীবিকা জন্য অত্যন্ত উপযোগী।
৪. থার মরুভূমি (Thar Desert)
ভারতের পশ্চিমাংশে অবস্থিত থার মরুভূমি (Rajsthan Desert) একটি উল্লেখযোগ্য শুষ্ক ভূমিরূপ। এটি ভারতের রাজস্থান রাজ্যের প্রধান অংশকে আবৃত করে এবং পাকিস্তানের অংশেও বিস্তৃত। মরুভূমির ভূমি প্রাথমিকভাবে বালি, শিলা এবং কংক্রিটের মাধ্যমে গঠিত, এবং এখানে বৃষ্টিপাত অত্যন্ত কম। থার মরুভূমির মধ্যে কিছু ছোটখাটো পাহাড়, খরা, এবং বালির টিলা (sand dunes) রয়েছে।
৫. উপকূলীয় অঞ্চল (Coastal Plains)
ভারতের পূর্ব এবং পশ্চিম উপকূলগুলি সমুদ্রের কাছাকাছি অবস্থিত এবং এসব অঞ্চলে উপকূলীয় সমভূমি (Coastal Plains) গড়ে উঠেছে। দুটি প্রধান উপকূলীয় অঞ্চল হলো:
- পশ্চিম উপকূল: এখানে মহারাষ্ট্র, গুজরাট, কেরালা এবং কর্ণাটকের উপকূল রয়েছে। এই অঞ্চলে মুম্বাই উপকূল এবং কোচি উপকূল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ।
- পূর্ব উপকূল: এখানে ওড়িশা, এপিএ, বঙ্গোপসাগর এবং কোস্টাল অন্ধ্র প্রদেশ অন্তর্ভুক্ত।
এই উপকূলীয় অঞ্চলগুলি সমুদ্রের কাছাকাছি হওয়ার কারণে সমুদ্রস্রোত এবং বৃষ্টি অনেক প্রভাব ফেলে। পশ্চিম উপকূলে বৃষ্টি (monsoon rains) এবং পূর্ব উপকূলে সাইক্লোন প্রভাবিত হয়ে থাকে।
৬. আয়তনবাদী এলাকায় বিচ্ছিন্ন ভূমিরূপ (Isolated Landforms)
ভারতের বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন অঞ্চল যেমন:
- আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ: ভারত মহাসাগরে অবস্থিত এই দ্বীপপুঞ্জে প্রচুর ছোট ছোট দ্বীপ এবং সৈকত রয়েছে।
- লক্ষাদ্বীপ: এটি ভারত মহাসাগরে একটি সুতীব্র প্রবাল দ্বীপপুঞ্জ।
- বহিরাঙ্গন পাহাড় (Outer Hills): দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন স্থানে উঁচু পাহাড় এবং ছিন্ন ভূমিরূপ তৈরি হয়েছে, যেমন নিলগিরি পাহাড়, সহ্যাদ্রি পর্বত।
৭. প্রাকৃতিক সম্পদ
ভারতের ভূমিরূপের বৈচিত্র্য শুধু প্রাকৃতিক দৃশ্যমানতার কারণে নয়, বরং এর বিভিন্ন স্থানে রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ। এই ভূমিরূপের কারণে এখানে রয়েছে বিস্তৃত কৃষি অঞ্চল, জলাশয়, খনিজ সমৃদ্ধি, এবং বৈচিত্র্যময় জীবজগত।
উপসংহার:
ভারতের ভূমিরূপ দেশটির ভূগোলের অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম মূল দিক। এটি দেশের পরিবেশ, কৃষি, শিল্প, এবং মানুষের জীবনযাত্রার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। ভারতের ভূমিরূপের এই বৈচিত্র্য, যেমন হিমালয় পর্বতমালা, গঙ্গা সমভূমি, থার মরুভূমি, এবং উপকূলীয় অঞ্চলগুলি দেশের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।