মৌর্য যুগ:
মৌর্য যুগ (Maurya Empire) প্রাচীন ভারতের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশাল সাম্রাজ্য ছিল, যা ৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত ছিল। এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য দ্বারা এবং তার পুত্র বিন্দুসার ও পাঠলিপুত্রের রাজা অশোক সহ পরবর্তী শাসকদের মাধ্যমে এটি সমৃদ্ধি লাভ করেছিল।
মৌর্য যুগের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো এবং গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস নিম্নরূপ:
মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা:
- চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (Chandragupta Maurya) – মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা:
- চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ নন্দ বংশকে পরাজিত করে ভারতের পাটলিপুত্র (বর্তমান পাটনা, বিহার) কে রাজধানী করে মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
- চাণক্য (কৌটিল্য বা विष्णুগुप्त) ছিলেন চন্দ্রগুপ্তের গুরু এবং প্রধান উপদেষ্টা, যিনি অর্থশাস্ত্র নামক বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন, যা রাষ্ট্র পরিচালনার উপর গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।
মৌর্য সাম্রাজ্যের বিস্তার:
- বিন্দুসার (Bindusara):
- চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পুত্র বিন্দুসার সাম্রাজ্যের পরিধি আরও বিস্তৃত করেন। তিনি দক্ষিণ ভারতের অনেক রাজ্যকে জয় করেন এবং সাম্রাজ্যকে একটি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করেন।
- অশোক (Ashoka):
- অশোক মহা (Ashoka the Great) ছিলেন মৌর্য সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বিখ্যাত ও শক্তিশালী রাজা, এবং তার শাসনকাল ছিল প্রায় ২৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত।
- অশোকের শাসনকাল ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী এবং শান্তিপূর্ণ, বিশেষ করে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের পর ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং মানবতার পক্ষে অনেক কাজ করেন। তাঁর শাসনকালে রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের জন্য কল্যাণমূলক কর্মসূচি চালানো হয়।
- অশোকের শাসনকাল পরবর্তী সময়ে ভারতের ইতিহাসে "অশোকীয় যুগ" হিসেবে পরিচিত হয়। তিনি অশোক স্তম্ভ (Ashoka Pillars) এবং ধর্মযাত্রা চালিয়েছিলেন, যা তাঁর শাসনের ইতিহাস ও ধর্মীয় দর্শনের প্রতীক।
মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা:
- কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা:
- মৌর্য সাম্রাজ্য ছিল একটি অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র, যেখানে রাজা (সম্রাট) প্রধান সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। রাজ্যের প্রশাসন শক্তিশালী ও সুবিন্যস্ত ছিল, এবং একাধিক বিভাগে বিভক্ত ছিল।
- চাণক্য (কৌটিল্য) ছিলেন মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক নীতি ও শাসনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর অর্থশাস্ত্র গ্রন্থ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি নির্ধারণে সহায়ক হয়।
- অর্থনীতি ও বাণিজ্য:
- মৌর্য সাম্রাজ্যের অর্থনীতি ছিল কৃষি, বাণিজ্য, এবং শিল্পনির্ভর। ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্য প্রসারিত ছিল এবং পাটলিপুত্র ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র।
- দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরের বাণিজ্যও সমৃদ্ধ ছিল, এবং শিলালিপি ও অশোক স্তম্ভের লেখন থেকে জানা যায় যে, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পকারখানাগুলির তদারকি ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী।
ধর্ম ও সংস্কৃতি:
- ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা:
- অশোকের রাজত্বের সময়, তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন এবং এর প্রচার করতে শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন স্থানে ধর্মস্তম্ভ স্থাপন করেন, যা বৌদ্ধ ধর্মের আদর্শ ও শান্তির বার্তা বহন করে।
- তার শাসনকালে, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় রাখা হয়েছিল। অশোকের প্রচেষ্টায় ভারতের নানা অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার ঘটে।
- শিল্প ও সংস্কৃতি:
- মৌর্য যুগে শিল্প, স্থাপত্য এবং সঙ্গীতের বিকাশ ঘটে। অশোকের সময়কার অশোক স্তম্ভ এবং ধর্মস্তম্ভ তার শাসনের উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য নিদর্শন।
- শিল্পের ক্ষেত্রে মূর্তির নির্মাণ ও শিল্পকর্মের বিকাশ ঘটেছিল। বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব থেকে বুদ্ধমূর্তি এবং অন্যান্য ধর্মীয় প্রতীক প্রতিষ্ঠিত হয়।
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন:
- মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন:
- অশোকের মৃত্যুর পর, মৌর্য সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে। তাঁর পুত্র এবং পরবর্তী শাসকদের মধ্যে শক্তির জন্য সংগ্রাম এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা সাম্রাজ্য পতনের কারণ ছিল।
- খ্রিস্টপূর্ব ১৮৫ সালে শুঙ্গ বংশের পুশ্যমিত্র শুঙ্গ মৌর্য সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে এবং শুঙ্গ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। এইভাবে মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
উপসংহার:
মৌর্য যুগ ছিল ভারতের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা রাজনৈতিক ঐক্য, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, এবং সাংস্কৃতিক উন্নতির দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অশোকের রাজত্ব এই যুগের শীর্ষ পর্যায় ছিল, যেখানে সাম্রাজ্য প্রসারিত ছিল, এবং সামাজিক ও ধর্মীয় পরিবর্তন ঘটেছিল।
গুপ্ত সাম্রাজ্য:
গুপ্ত সাম্রাজ্য (Gupta Empire) ছিল প্রাচীন ভারতের এক শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ সাম্রাজ্য, যা ৩২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই সাম্রাজ্য ভারতের ইতিহাসে "সোনালী যুগ" বা গোল্ডেন এজ হিসেবে পরিচিত, কারণ এটি ভারতীয় সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, সাহিত্য, কলা, এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার একটি বিশেষ সময় ছিল। গুপ্ত সাম্রাজ্য ছিল ভারতের ইতিহাসের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা:
1. গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা:
গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত
গুপ্ত
(Chandragupta Gupta), যিনি
৩২০
খ্রিস্টপূর্বাব্দ
নাগাদ ভারতবর্ষের উত্তরাংশে একটি শক্তিশালী রাজ্য
প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পাটলিপুত্র (বর্তমান পাটনা, বিহার) কে রাজধানী করে
গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
2. গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রথম শাসক:
চন্দ্রগুপ্ত গুপ্তের পর তার পুত্র
সমুদ্রগুপ্ত
(Samudragupta) শাসন করেন, যিনি সাম্রাজ্যকে ব্যাপকভাবে
বিস্তৃত করেন এবং একাধিক
প্রতিবেশী রাজ্য জয় করেন। তিনি
"উত্তম যোদ্ধা" (The Napoleon
of India) হিসেবে পরিচিত।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের শাসনকাল:
1. চন্দ্রগুপ্ত গুপ্ত:
চন্দ্রগুপ্ত গুপ্তের শাসনকালেই গুপ্ত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং তিনি
রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক কাঠামো
শক্তিশালী করেন। তার শাসনকাল রাজনৈতিক
স্থিতিশীলতা এবং সামরিক শক্তির
দিকে অগ্রসর ছিল। তিনি ধর্মীয়
সহিষ্ণুতা এবং বাণিজ্যিক উন্নতির
দিকে গুরুত্ব দেন।
2. সমুদ্রগুপ্ত:
সমুদ্রগুপ্ত গুপ্ত সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শাসক এবং তার
শাসনকাল ছিল অত্যন্ত সফল।
তিনি অনেক ছোট রাজ্য
ও জনপদ জয় করে
গুপ্ত সাম্রাজ্যকে এক বৃহৎ সম্রাজ্যে
পরিণত করেন। তার মুদ্রিত শিলালিপি
থেকে জানা যায় যে,
তিনি বীরত্ব, সাহসিকতা, এবং শাস্ত্রের প্রতি
গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
3. চন্দ্রগুপ্ত দ্বিতীয় (চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য):
চন্দ্রগুপ্ত দ্বিতীয় (Chandragupta II) গুপ্ত সাম্রাজ্যের তৃতীয় শাসক ছিলেন এবং
তার শাসনকাল ছিল সাম্রাজ্যের সবচেয়ে
উজ্জ্বল সময়। তার শাসনকালে
গুপ্ত সাম্রাজ্য শীর্ষে পৌঁছেছিল এবং ভারতের বিভিন্ন
অঞ্চলে বাণিজ্য ও সংস্কৃতির বিকাশ
ঘটে। এই সময়কালেই ভারতীয়
সংস্কৃতির "সোনালী যুগ" গড়ে ওঠে। চন্দ্রগুপ্ত
বিক্রমাদিত্য পন্ডিতদের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন, এবং তার সভায়
কবি
কালিদাস,
বরাহমিহির,
ভাস এবং অর্যভট্ট মত মহান পন্ডিতদের
উপস্থিতি ছিল। তিনি বিক্রমাদিত্য
নামেও পরিচিত, এবং তার শাসনকালে
গুপ্ত সাম্রাজ্য ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্য হয়ে ওঠে।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা:
· কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা:
গুপ্ত সাম্রাজ্য ছিল একটি কেন্দ্রীভূত
শাসনব্যবস্থা, যেখানে রাজা সর্বোচ্চ ক্ষমতার
অধিকারী ছিলেন। রাজ্যের প্রধান প্রশাসনিক কাজকর্ম রাজা বা শাসক
দ্বারা পরিচালিত হতো। শাসনব্যবস্থা ছিল
মন্ত্রিপরিষদভিত্তিক, এবং সেনাপতিদেরও গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা ছিল সাম্রাজ্যের শাসনকার্যে।
· রাজস্ব ব্যবস্থা:
রাজস্ব আদায়ের জন্য গুপ্ত শাসকরা
একাধিক কর ব্যবস্থা প্রবর্তন
করেছিলেন, যেগুলির মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহ করা হতো। কৃষি
ছিল মূল অর্থনীতি, এবং
অন্যান্য বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রাজস্ব বাড়ানো হতো।
· নাগরিক অধিকার ও সমাজ:
গুপ্ত সাম্রাজ্যে সমাজ ব্যবস্থা মূলত
বর্ণ
ব্যবস্থা
অনুসরণ করত, যেখানে ব্রাহ্মণ,
ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র শ্রেণী
ছিল। তবে এই সময়কালেই
বাণিজ্যিক
ও
ধর্মীয়
সহিষ্ণুতা
প্রচলিত ছিল।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের সোনালী যুগ:
1. বিজ্ঞান ও গণিত:
গুপ্ত যুগে ভারতের বিজ্ঞান
ও গণিতের অগ্রগতি ছিল উল্লেখযোগ্য। অর্যভট্ট (Aryabhata) গণিত এবং
জ্যোতির্বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তার "অর্যভট্টীয়"
গ্রন্থে সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর ঘূর্ণন এবং অন্যান্য বৈজ্ঞানিক
তত্ত্ব তুলে ধরা হয়েছিল।
2. সাহিত্য ও সংস্কৃতি:
কালিদাস
(Kalidasa), ভাস
(Bhasa), এবং ভারাহমিহির (Varahamihira)
ছিলেন গুপ্ত যুগের অন্যতম বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নাট্যকার। কালিদাসের লেখা
"শকুন্তলা"
এবং "মেঘদূত"
আজও বাংলা সাহিত্যের প্রধান রত্ন।
- গুপ্ত যুগের শিল্পকলা এবং স্থাপত্যের উন্নতি লক্ষণীয় ছিল। পাথরের মূর্তি এবং শিলা পেইন্টিংয়ের মাধ্যমে ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ভাবনা প্রকাশিত হয়েছিল।
3. ধর্ম:
গুপ্ত সাম্রাজ্যে হিন্দু
ধর্ম
ছিল প্রধান ধর্ম, তবে বৌদ্ধ ধর্ম
এবং জৈন ধর্মও প্রচলিত
ছিল। গুপ্ত রাজারা শিব, বিষ্ণু, এবং দেবী
শাক্তির
পূজায় নিবেদিত ছিলেন। তবে এই সময়কালেই
বৌদ্ধ ধর্মের পতন ঘটেনি, বরং
গুপ্ত যুগে বৌদ্ধ ধর্মের
প্রসার ঘটেছিল।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন:
গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটে ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি, মূলত:
1. ভিতরের দুর্বলতা:
একাধিক শাসকের দুর্বলতা, প্রশাসনিক অসঙ্গতি, এবং অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের
কারণে সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে দুর্বল
হয়ে পড়ে।
2. হুন আক্রমণ:
হুন
(Huns) নামে এক গোষ্ঠী ভারতবর্ষে
আক্রমণ করে এবং গুপ্ত
সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে দেয়। এর
ফলে সাম্রাজ্য ধ্বংস হতে থাকে।
উপসংহার:
গুপ্ত সাম্রাজ্য ছিল ভারতের ইতিহাসের একটি সোনালী যুগ, যেখানে সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প এবং ধর্মে বিপুল অগ্রগতি হয়েছিল। এটি ভারতের ইতিহাসে "গোল্ডেন এজ" হিসেবে পরিচিত, এবং গুপ্ত যুগের অবদান আজও ভারতীয় সভ্যতার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।