
বৈদিক যুগ :
বৈদিক যুগ (Vedic Age) ছিল প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়, যা ঋগ্বেদসহ অন্যান্য ভেদগ্রন্থের সৃষ্টির সময়কাল ছিল। এই যুগের নামকরণ হয়েছে বেদ নামে পরিচিত ধর্মীয় গ্রন্থগুলির ভিত্তিতে, যেগুলি এই সময়কার সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতি, এবং চিন্তা-ধারার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিফলন।
বৈদিক যুগের সময়কাল:
বৈদিক যুগ সাধারণত খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ৫০০ অব্দ পর্যন্ত বিবেচিত হয়। তবে, বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় সময়সীমা কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে।
বৈদিক যুগের মূল বৈশিষ্ট্য:
- বেদ:
- বৈদিক যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল বেদ গ্রন্থগুলির সৃষ্টি। বেদগুলি হল প্রাচীন ভারতের ধর্মীয়, দার্শনিক এবং সাংস্কৃতিক গ্রন্থ।
- চারটি বেদ রয়েছে:
- ঋগ্বেদ: প্রাচীনতম বেদ এবং বৈদিক সভ্যতার অন্যতম প্রধান ধর্মগ্রন্থ। এতে দেবতা, যজ্ঞ, এবং মানবজীবনের নানা দিক নিয়ে গান, স্তোত্র ও মন্ত্র রয়েছে।
- যজুর্বেদ: যজ্ঞ এবং পূজার নিয়মাবলি সংক্রান্ত বেদ।
- সামবেদ: গান ও সঙ্গীতের বেদ।
- আথর্ববেদ: চিকিৎসা, জাদুবিদ্যা, এবং দৈনন্দিন জীবনের প্রথা বিষয়ক বেদ।
- ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা:
- বৈদিক যুগের ধর্মীয় জীবন ছিল পূজা, যজ্ঞ, এবং তপস্যাতে ভরপুর। দেবতাদের পুজোর মাধ্যমে পৃথিবী ও মানবজীবনকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করা হত।
- এই যুগে প্রধানত দেবতাগণ যেমন ইন্দ্র (আকশের দেবতা), অগ্নি (অগ্নির দেবতা), বরুণ (পানি ও অন্ধকারের দেবতা), ঊষা (সকাল দোয়ানি দেবী) ইত্যাদি পূজিত হতো।
- সমাজ ব্যবস্থা:
- বৈদিক সমাজ ছিল বর্ণব্যবস্থা বা কাস্ট সিস্টেম দ্বারা পরিচালিত। সমাজ মূলত চারটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল:
- ব্রাহ্মণ (ধর্মীয় নেতা ও পুরোহিত)
- ক্ষত্রিয় (যুদ্ধবিদ এবং শাসক)
- বৈশ্য (বাণিজ্যিক ও কৃষিকর্মী)
- শূদ্র (শ্রমিক ও সেবক)
- এই শ্রেণীবিভাগ ছিল সামাজিক ও ধর্মীয় ভিত্তিতে, এবং সবার নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্ম ছিল।
- কৃষি ও অর্থনীতি:
- বৈদিক সমাজ ছিল মূলত কৃষিভিত্তিক। মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি, এবং তারা বিভিন্ন শস্য যেমন গম, যব, চাল, জোয়ার ইত্যাদি চাষ করত।
- বাণিজ্য এবং পশুপালনও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। গবাদি পশু, বিশেষত গরু, ছিল বৈদিক সমাজের অন্যতম মূল্যবান সম্পদ।
- রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থা:
- বৈদিক যুগে রাজ্য ছিল স্বাধীন ও শাসকের অধীনে গঠিত, এবং রাজা বা শাসককে রাজন্য বা রাজা বলা হত। রাজা সাধারণত ধর্মীয় নেতাও ছিল, এবং তার শাসন কার্য ছিল দেবতাদের নীতি অনুসরণ করে।
- রাজ্যগুলি সাধারণত ছোট ছোট ইউনিটে বিভক্ত ছিল, তবে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাও কিছু অঞ্চলে ছিল, যেমন বাজি বা গণসভা।
- ভাষা ও সাহিত্য:
- বৈদিক যুগে সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করা হত এবং এটি ছিল লেখার জন্য ব্যবহৃত ভাষা। বেদ এবং অন্যান্য ধর্মীয় সাহিত্য ছিল সংস্কৃতে লেখা।
- সাহিত্য এবং কবিতা প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার সাংস্কৃতিক অংশ ছিল, যা বিভিন্ন ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ধারণা, সামাজিক প্রথা, এবং দৈনন্দিন জীবন তুলে ধরেছিল।
- শিল্প ও প্রযুক্তি:
- বৈদিক যুগে শিল্পকলা এবং কারুশিল্পের চর্চা শুরু হয়েছিল। মানুষের পোশাক, অলংকার, মৃৎশিল্প, এবং নির্মাণশিল্পে তাদের দক্ষতা ছিল।
- ঘরবাড়ি, যন্ত্রপাতি, এবং গৃহস্থালি পণ্য তৈরি করা হত।
- বৈদিক শিক্ষা:
- বৈদিক যুগে শিক্ষা ও জ্ঞান ধারণা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। শিক্ষকরা গুরুরূপে গৃহস্থালি শিক্ষার ব্যবস্থা করতেন, এবং শিষ্যরা গুরু-শিষ্য সম্পর্কের মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করত।
- ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের উপর যেমন ধর্ম, গাণিতিক চিন্তা, আধ্যাত্মিকতা এবং শাস্ত্র আলোচনা হত।
বৈদিক যুগের শেষ:
বৈদিক যুগের শেষের দিকে, আর্যরা বিভিন্ন অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করলে অধুনা ভারতীয় ধর্মীয় ধারণা এবং সামাজিক কাঠামো আরও জটিল হতে থাকে। পাশাপাশি, আর্যদের পাশাপাশি দ্রাবিড় ও মূর্তিপূজক সমাজগুলির আগমনও ঘটেছিল। এভাবেই, বৌদ্ধ, জৈন, এবং অন্যান্য ধর্মের সূচনা হয়।
মহাজনপদ:
মনে করা হয় প্রাচীন সাহিত্যে উল্লিখিত বিভিন্ন ক্ষুদ্রকায় জনগোষ্ঠী উপমহাদেশের অবশিষ্টাংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। এই রাজ্যগুলির কোনো কোনোটিতে রাজপদ ছিল বংশানুক্রমিক; আবার কোনো কোনো রাজ্যে শাসক নির্বাচিত হতেন। শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ভাষা ছিল সংস্কৃত। যদিও উত্তর ভারতের জনসাধারণ প্রাকৃতের বিভিন্ন উপভাষায় কথা বলতেন। ৫০০/৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সিদ্ধার্থ গৌতমের সময়কালে এই ষোলোটি মহাজনপদের অধিকাংশ সংযুক্ত হয়ে বৎস, অবন্তী, কোশল ও মগধ রাজ্যচতুষ্টকের সঙ্গে মিলিত হয়।
হিন্দু ধর্মানুষ্ঠান এই সময় অত্যন্ত জটিল ও পুরোহিত শ্রেণীনির্ভর হয়ে পড়ে। মনে করা হয় পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য উপনিষদ পরবর্তী বৈদিক যুগের শেষভাগ ও মহাজনপদ যুগের প্রথম ভাগে (৬০০ – ৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) রচিত হয়। ভারতীয় দর্শনের উপর গভীর প্রভাব সৃষ্টিকারী উপনিষদ ছিল বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্মের বিকাশের সমসাময়িক। এই কারণে এই যুগকে ভারতের দর্শনচিন্তার সুবর্ণযুগ বলে মনে করা হয়।
মনে করা হয়, খ্রিষ্টপূর্ব ৫৩৭ অব্দে বোধি লাভ করে সিদ্ধার্থ গৌতম ‘বুদ্ধ’ নামে পরিচিত হন। একই সময় চতুর্বিংশতিতম জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর একই ধরনের অপর একটি ধর্মতত্ত্ব প্রচার করেন; পরবর্তীকালে যা জৈনধর্ম নামে পরিচিত হয়।অবশ্য জৈন বিশ্বাস অনুযায়ী তাদের ধর্মতত্ত্ব অনাদিকাল থেকেই প্রচলিত। এও মনে করা হয় যে বেদে কয়েকজন জৈন তীর্থঙ্কর ও শ্রমণ ধর্মান্দোলনের অনুরূপ এক আধ্যাত্মিক সংঘাদর্শের কথা লিখিত আছে।
বুদ্ধের শিক্ষা ও জৈন ধর্মতত্ত্ব নির্বাণতত্ত্বের কথা বলে। প্রাকৃত ভাষায় রচিত হওয়ায় তাদের ধর্মমত সহজেই সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠতে সক্ষম হয়। হিন্দুধর্ম ও ভারতীয় অধ্যাত্মতত্ত্বের বিভিন্ন অভ্যাস যথা নিরামিষ ভক্ষণ, পশুবলি নিবারণ ও অহিংসা প্রভৃতির উপর এই নতুন ধর্মমতের প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর। জৈনধর্মের ভৌগোলিক বিস্তার ভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীরা বুদ্ধের শিক্ষাদর্শকে মধ্য এশিয়া, পূর্ব এশিয়া, তিব্বত, শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
পারসিক ও গ্রিক আক্রমণ :
৫২০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রথম দারায়ুসের রাজত্বকালে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের (বর্তমান পূর্ব আফগানিস্তান ও পাকিস্তান) অধিকাংশ অঞ্চল পারসিক হখামনি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং পরবর্তী দুই শতাব্দী উক্ত সাম্রাজ্যেরই অধীনস্থ থাকে। ৩২৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এশিয়া মাইনর ও হখামনি সাম্রাজ্য জয় করে মহামতি আলেকজান্ডার উপনীত হন ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে। সেখানে হিদাসপিসের যুদ্ধে (অধুনা ঝিলম, পাকিস্তান) রাজা পুরুকে পরাস্ত করে পাঞ্জাবের অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে নেন। এরপর আলেকজান্ডার মগধের নন্দ সাম্রাজ্য ও বাংলার গঙ্গারিডাই সাম্রাজ্যের সম্মুখীন হতে চাইলে বৃহত্তর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সম্মুখীন হওয়ার ভয়ে ভীত ক্লান্ত তার বাহিনী হাইফেসিসে (বর্তমান বিপাশা নদী) বিদ্রোহ করে এবং পূর্বদিকে অগ্রসর হতে অস্বীকার করে। সেনা আধিকারিক কোনাসের সঙ্গে আলোচনাক্রমে আলেকজান্ডার প্রত্যাবর্তনকেই শ্রেয় বিবেচনা করেন।
পারসিক ও গ্রিক আক্রমণ ভারতীয় সভ্যতায় গুরুত্বপূর্ণ পরোক্ষ প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল। পারসিকদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা উপমহাদেশের ভবিষ্যত সরকার ব্যবস্থায়কে, বিশেষত মৌর্য প্রশাসনকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। একই সঙ্গে গান্ধার অঞ্চল (অধুনা আফগানিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তান) ভারতীয়, পারসিক, মধ্য এশীয় ও গ্রিক সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র হয়ে ওঠে। এই অঞ্চলে গ্রিকো-বৌদ্ধধর্ম নামে এক মিশ্র সংস্কৃতির জন্ম হয়; যা পঞ্চম খ্রিষ্টাব্দ অবধি স্থায়ী হয়ে মহাযান বৌদ্ধধর্মের শৈল্পিক বিকাশে বিশেষ সহায়তা করে।